Click On Ads

Ticker

6/recent/ticker-posts

চাকমা জাতির প্রাচীন সভ্যতা

 

ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্য দিয়াই কোনো জাতির ঘটনা বহুল প্রাচীন যুগের  তথ্য অবগত হওয়ার প্রধান উপায়। চাকমা জাতি ইতিহাস লিখক সতীশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের পুস্তকের প্রথম পৃষ্ঠাতেই চোখে পড়ে। বিদেশীয় গ্রন্থগারগনের অস্পষ্ট মতামত। যাহারা প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন চাকমারা পার্বত্য অঞ্চলেরই আদিম অসভ্য বর্বর শ্রেণীভুক্ত।
    প্রাচীন বৌদ্ধ যুগের গৌরবোজ্জল কীর্তি অবগত হইতে হইলে বৌদ্ধ সাহিত্য ত্রিপিটক ও জাতক প্রভৃতি ধর্মীয় সাহিত্যের অনুশীলন যেমন অপরিহার্য, অনুরুপভাবে কোরআন হাদিস প্রভৃতি এবং বেদ, পুরাণ ইত্যাদি প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থাদির দ্বারা যথাক্রমে মুসলমান ও হিন্দুদের প্রাচীন সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। বিভিন্ন যুগে সাহিত্যের দ্বারাই জাতীয় জীবনের রুপ প্রকাশ পাইয়াছে। কিন্তু চাকমাদের ঐরুপ কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ নাই। থাকিলেও তাহা এখন এই দেশ আমাদের হাতে নাই। যেহেতু জাতীর প্রকৃত নামটিও হারাইয়া গিয়াছে এবং বর্তমানে প্রচলিত ‘‘ চাকমা ’’ নামটি ব্রক্ষ্ম বাসীদেরই প্রদত্ত মধ্য যুগীয় কোনো এক আখ্যার অপভ্রংশ বিশেষ।
    কাজেই চাকমাদের প্রাচীন সভ্যতা অনুধাবন করিতে হইলে তাহাদের আদি বাসস্থান, উত্থান -পতন, স্থান পরিবর্তন প্রভৃতির ব্যাপারে তাহাদের প্রাচীন  লোক-সাহিত্য, কিংবদন্তি, পুথি ,ধর্মীয় গ্রন্থ, ইতিহাস প্রভৃতি এবং তাহাদের লুপ্ত প্রায় শিল্পকলা ও শিক্ষার বিবিধ নিদর্শনের বাস্তব তথ্যকে অবহেলা করিলে চলিবেনা। এক সময়ে ইহারা যে এক বিশেষ জাতির অংশ বিশেষ ছিলেন, ইহার বিশ্বসযোগ্য প্রমাণাদি যদিও এখনও পাওয়া যায়, কিন্তু ঘটনাবহুল বিপর্যয়ের ভিতর দিয়া এই জাতির নামটি পর্যন্ত হারাইয়া যাওয়াতে প্রকৃত তথ্য আবিস্কারের পথে সম্ভাব্য বহু স্থান পরিভ্রমণ ও বহু জাতির সংস্পর্শে আসিবার প্রয়োজনিয়তা রহিয়াছে। তজ্জন্য যে প্রচুুর অর্থ  ও সময়র দরকার , তাহা ব্যয় করা যদিও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নাই, তথাথি সাধ্যমত ইহার যথার্থতা নির্ণয়ে সচেষ্ট হইয়াছি।
    পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন উপজাতি ও চাকমাদের সম্পর্কে যেসব উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে চাকমাগণ কোথা হইতে আসিয়াছেন এবং তাহাদের আদি উৎপত্তি বা কোথায় ? বহু গ্রন্থাগার ঐ বিষয়ে আলোকপাত করিয়াছেন। কিন্তু এই জাতির সঠিক পরিচয় নির্ণয়ে, কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া তাহাদের পক্ষে সম্ভব  হয় নাই।

    এই বিষয়টি পুস্তকের পরবর্তি অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হইয়াছে।  কাজেই মূল বিষয়টিতে গলদ থাকার কারণে েএই সমস্ত গ্রন্থাগারগণ  এই জাতির পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন অসামঞ্জ্যস্য মত ব্যক্ত করিয়াছেন। যে কোন জাতির পরিচয় ক্ষেত্রে দোষ বা গুণ দুইটারই বিশিষ্ট অংশ রহিয়াছে। কেবল দোষ কিংবা গুণগুলি গোপন করতঃ একতরফা বিচার করিয়া গেলে , তাহা ইতিহাস নামের অযোগ্যতারই প্রতিপন্ন করে। এইরুপ কতিপয় ‌ঐতিহাসিক চাকমা জাতির প্রাচীন সভ্যতাকে মোটেই স্বীকার করিতে চাহেন নাই। অধিকন্তু বিজাতিয় একতরফা মনোভাব নিয়া, তাহাদের পার্বত্য বন্য-জাতি রুপে চিত্রিত করিয়াছেন। কোন জাতির ইতিহাস ইতিহাস রচনায় সেই জাতির অতীত ইতিহাসের সাথে তার সাহিত্যের পর্যালোচনা যে বিশেষ সহায়ক তাহা নিঃসন্দেহে স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু চাকমা সমাজে প্রাচীন লোকগীতি, পুথিপত্র ও হস্তলিপিতে রক্ষিত সাহিত্যের  উপাদানে যেসব আকর্ষণীয় তথ্যাদি অবগত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল; তাহারা ঐসব তথ্যাদি সংগ্রহে সচেষ্ট হন নাই। অধিকন্তু মধ্যযুগের ব্রক্ষ্মদেশীয় ইতিহাসে চাকমাদের সম্পর্কে যেসব প্রামাণ্য ঐতিহাসিক স্বাক্ষর রহিয়াছে এই জাতির গৌরবোজ্জল অধ্যায়ের এক বিরাট অংশও তাহাদের কাছে অজ্ঞাত রহিয়া গিয়াছে। অথবা জ্ঞাত থাকা সত্বেও তাহারা যে কোন কারণেই হউক তাহা উল্লেখ করেন নাই।

    এই পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের গেংহুলি গীতপদ লোকসাহিত্য,চাদিগাং ছড়া পালা ,গোজেন লামা, আগরতারা, রাধামন ধনপুদির পালা, বারমাস , তালিক শাস্ত্র, উবোগীত, সাদেংগীরি উপখ্যান, জ্ঞান প্রদীপ, ফকিরী কালাম প্রভৃতিতে চাকমা জাতির প্রাচীন ইতিহাস ও সাহিত্য সম্পর্কে, তথ্যাদি অবগত হইবার যথেষ্ট সুযোগ রহিয়াছে। ইহাতে দর্শন শাস্ত্র , নীতি গাথা সুত্র, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, চিকিৎসা শাস্ত্র , ভজন বন্দনার পদাবলি, ঐতিহাসিক তথ্য প্রভৃতি বিভিন্ন সাহিত্যের সমাবেশ রহিয়াছে। ঐসব সম্পদশালী সাহিত্যের নিদর্শনের দ্বারা চাকমা জাতির যে প্রাচীন সভ্যতার আভাস পাওয়া যায়, তাহা কখনও উপেক্ষণীয় হইতে পারেনা। প্রত্যেক জাতির প্রাচীন মূল ধারাই হইল তাহার অতীতের সাহিত্য। আর ঐসব রচনা, অনেক স্থলে প্রাচীন কিংবদন্তী মূলক হইলেও, ্‌ইতিহাস ইহা উপেক্ষা করিতে পারেনা। কারণ ঐতিহাসিক পূর্ব যুগের প্রত্যেক জাতির আদি ইতিহাসই অনেক স্থলে মৌখিক প্রচলিত কাহিনীর সমষ্ঠি মাত্র। পুর্বোক্ত সাহিত্যের মধ্যে চাকমা জাতির ভাষা, ভাব ও চরিত্রের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রহিয়াছে। অনেক সময় এর মাধ্যমে ঐতিহাসিক তথ্য উদঘাটনের সম্ভাবনাও অপরিসীম। অধুনা, কালের প্রভাবে ঐসব প্রাচীন সাহিত্যস সমাজে এখন আর তেমন আদরনীয় না হইলেও , এই জাতির জীবনে তাহার এখনও বিলুপ্তি ঘটে নাই। ঔসব পুঁথি, পাাচালি , কবিতা ইত্যাদি চাকমা বাঙ্গালা ভাষায় রচিত। মনোযোগ সহকারে পড়িলে বা শ্রবণ করিলে বিকৃত বাঙ্গালা ভাষা বলিয়াই মনে হইবে। অবশ্য আগরতারা বিকৃত পালি ও ব্রক্ষ্মদেশীয় ভাষায় রচিত।

    সাধক কবি শিবচরণ চাকমা রচিত গোজেন লামার সমস্ত পদগুলি অতি সুন্দর ভজনার  ও বন্দনার সমষ্টি। সমস্ত গীত ভাবের উপদেশে পরিপূূর্ণভাবে রচনা করা হইয়াছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ডঃ বেনিমাধব বড়ুয়া এমএ; ডি-লিট গৈরিকা পত্রিকায় সাধু শিবচরণের গীতিপদ  গোজেন লামা সম্পর্কে মন্তব্য করিয়াছেন; গীতপদ গুলির রচনা সরল, সহজ ,প্রাণ স্পর্শী এবং স্থানে স্থানে গভীর ভাবদ্যোতক। উহাদের ভাষা বাঙ্গালা হইলেও চাকমা কথ্য ভাষায় ছাঁচে ঢালা। রচনার মধ্যে কোথাও কষ্টকল্পনা নাই। নিহীত ভাবগুলি স্বভাবসিদ্ধ , দ্যোতনায় চমৎকার। গীতগুলির মধ্যে প্রাণের যে ব্যাকুলতা পুনঃ পুনঃ ব্যক্ত হইয়াছে তাহা সমগ্র চাকমা বৌদ্ধ জাতিরাই নিভৃত হৃদয়ের  বেদনা। ডঃ বেনিমাধব বড়ুয়ার এই মন্তব্যে, আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি যে, তিন শতাধিক বৎসরের পূর্বেও  চাকমাদের মধ্যে জ্ঞানানুরাগী ও সাহিত্যিকের অভাব ছিলনা। ঐ উদাসী কবির সময় কাল ছিল ষোড়শ শতাব্দী।

    দুঃখের বিষয়, বিদেশী গ্রন্থগারগণ চাকমা জাতির  ঐসব প্রাচীন সভ্যতাকে মোটেই স্বীকার করিতে চাহেন নাই অথবা এই বিষয়ের তথ্যাদি আবিস্কারের কোন আয়াস স্বীকার না করিয়া কোন কোন ক্ষেত্রে তাহারা ইহার বিপরিত ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ঘটনার বিপর্যয়ে বহুকাল যাবৎ শিক্ষা ও ভুয়োদর্শনের অভাবে বুুদ্ধি ও শিল্পে উন্নত পার্শ্ববর্তী জেলার সাথে চাকমার সমতালে চলিবার সামর্থ্য হারাইলেও বিদেশী ঐতিহাসিক চিত্রিত বর্বর শ্রেণীভুক্ত যে নহে তাহা স্বীকার করিতে হয়। চাকমা ভাষা, গারো, মগ , ত্রিপুরা,  ‍মুরুং বা কুকীদের ভাষার মত বাঙ্গালা ভাষীদের কাছে দুর্বোধ্য নহে। অথচ ইহারাও বাঙ্গালীদের সংস্পর্শে বাস করিতেছেন কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত। তদুপরি চাকমা ভাষায় শতকরা ৮০টির মত বাঙ্গালা ও সংস্কৃত শব্দের সংমিশ্রণ রহিয়াছে। বিগত প্রত্যেক আদম শুমারিতে, চাকমা ভাষাকে চাকমা-বাঙ্গালা আখ্যা প্রদান করা হইয়াছে। আসামী ভাষার সাথেও ইহার যথেষ্ট মিল থাকার কারণে সংস্কৃতের প্রভাব রহিয়াছে। যেহেতু আসামী ভাষার উপর সংস্কৃতের প্রবল প্রভাব বর্তমান।

    কালের স্রোতে আজ চাকমা ভাষার বর্ণমালা বিলুপ্তির পথে। প্রাচীন কাল হইতেই চাকমাদের ভাষার বর্ণমালার সাথে তাহার সাহিত্যও রহিয়াছে। এযাবৎ চাকমারা উপজাতি বলিয়া  কথিত হইলেও, ভাষা ক্ষেত্রে তাহাদের পৃথক বর্ণমালার অস্তিত্ব থাকায় উহা গভীর তাৎপর্য্য পূর্ণ। চাকমা ভাষার বর্ণমালা সম্পর্কে Linguistic Servey Of India গ্রন্থে যে মন্তব্য করা হইয়াছে তাহা এই-

"  A Broken Dialect of Bangali". It is almost worthy of the dignity of being classed as a separate language. It is written in an alphabet which, allowing for its curive form is almost indentical with Khimar character, Looas, Annam, Seam and at least in Southern Burma. It is not necessary to give a detail account of Chakma Grammar, which closely resemble that of Chittagong.

শ্রীযুক্ত বিরাজ মোহন দেওয়ান।


    চাকমাদের বর্ণমালার সাথে ব্রক্ষ্মদেশীয় বর্ণমালার অনেকটা মিল রহিয়াছে। ব্রক্ষ্মদেশীয় প্রভাব তাহাদের উপর বিস্তার লাভ করিবে, তাহা বলা বাহুল্য মাত্র। তবে ইহা অনস্বীকার্য যে, অসভ্য বর্বর জাতিদের মধ্যে কোনকালে বর্ণমালা বা সাহিত্য থাকা কি সম্ভব?

    ব্রক্ষ্মদেশে অবস্থানকালীন সম্পূর্ণ  ভিন্ন ভাষা ভাষী বর্মীদের সাথে তাহারা কয়েক শতাব্দী থাকিলেও ভাষার তেমন পরিবর্তন ঘটে নাই। তবে অনুমিত হয় তাহাদের ব্যবহারিক জীবনের সমস্ত কার্য্যাদি অতীতে স্থানীয় ভাষাতেই সম্পন্ন করিতে হইয়াছিল। ঐ কারণে হয়ত তাহাদের অতীতে কোন বর্ণ মালা থাকিলেও বিভিন্ন অবস্থার পরিবর্তনের সাথে তাহার বিলুপ্তি ঘটিয়াছে। বর্তমানে যে বর্ণমালা পরিদৃষ্ট হয়, তাহা উল্লেখিত দেশসমূহ বা সেই দেশীয় বর্ণমালার অনুকরণে গঠিত হইয়াছে মনে হয়। কালের স্রোতে বর্তমান বর্ণমালাও বিলুপ্তির পথে চলিয়াছে। চিরন্তন পরিবর্তনশীল মানব সমাজের এই জীবন ধারা। কিংবদন্তীমূলে সংবাদ পাওয়া যায়, ঐ সময়ে তাহারা তাল পাতা ও অলত্যা পাতা বা বলি কাগজ ব্যবহার করিতেন। এবং সময়ে পশুর চামড়ায় রাজার আদেশ প্রচারিত হইত। এই সঙ্গে বর্তমান বর্ণমালা প্রদর্শিত হইল।

    শ্রীযুক্ত নোয়ারাম চাকমা মহাশয় ইতিপুর্বে চাকমার পত্থম শিক্ষা নামে চাকমা বর্ণমালায় একটি পুস্তক প্রনয়ন করিয়াছেন। তাহার এই প্রচেষ্টা বিশেষরুপে প্রশংসার যোগ্য। জাতির বিলুপ্ত প্রায় একটা সম্পদ তিনি পুনঃরুদ্ধার করিবার কাজে ব্রত হইয়াছেন।

    যেই জাতির প্রাচীন কাল হইতে বর্ণমালা ও সাহিত্য রহিয়াছে এবং ব্রক্ষ্মদেশের বিভিন্ন অংশে যাহাদের এক সময়ে আধিপত্য করিবার প্রামাণ্য ইতিহাস রহিয়াছে তাহাদেরকে অসভ্য বর্বর আখ্যা প্রদান করা নিতান্ত অবিবেচকের কাজ হইয়াছে। প্রাচীন ভারতে ধর্ম  বিপ্লবে, সমাজ বিপ্লবে কত প্রাচীন কাহিনী আজ বিলুপ্ত প্রায় এবং কাল চক্রে পড়িয়া কত জাতি ও সমাজ যে, অতীতের গর্ভে  বিলীন হইয়াছে কে তাহার হিসাব রাখে? আমরা জানি জাতির প্রতীকরুপে চাকমা রাজবংশের সুদীর্ঘ  হাজার বৎসর অতীত কালের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারাবাহিক ইতিহাসের যোগসুত্র আরাকান ও ব্রক্ষ্মদেশীয় ইতিহাস ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত রাজমালা এবং শ্রীশ্রী রাজনামায় সুপরিস্পুট। সুতরাং উপযুক্ত প্রমাণ ও পরীক্ষা ব্যতিরেকে ঐ বিদেশী ঐতিহাসিকগণের অনুমতি মতামতের উপর কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিত নহে।

    এক সময়ে চম্পক নগরের চাকমা রাজকুমার বিজয়গিরি কর্তৃক অস্কাদেশ ( আরাকান সীমান্ত ) বিজিত হইলে, কালের স্রোতে ক্রমে ক্রমে তাহারা রাজ্য বিস্তার ও তথায় উপনিবেশ স্থাপন করেন। কালের অপূর্ব রহস্যে ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠে আরাকান ও উত্তর ব্রক্ষ্মে এক সমৃদ্ধ চাকমা রাষ্ট্র। জাতীয় জীবনের পথে হারাইয়া গিয়াছে অনেক স্মৃতি-অনেক প্রোজ্জল চিত্র। তবুও আজ দিগন্তের ওপার হইতে ব্রক্ষ্মদেশীয় ইতিহাস ( চুইজং-ক্যা-থাং ), আরাকানের ইতিহাস (দেঙ্গাওয়াদি আরেদ ফুং ) চাকমা জাতির প্রাচীন ইতিবৃত্ত সাক্ষ্য দেয়, ব্রক্ষ্মদেশীয় সেই বিক্রমশালী জাতির স্মৃতি। যেই জাতি এক সময়ে ব্রক্ষ্মদেশের ন্যায় স্বাধীন জাতিকে পরাভুত করিয়া  পাঁচ শতাব্দীরও অধীক কাল সেই দেশের বিভিন্ন অংশে তার আধিপত্য বিস্তার করতঃ শাষণ শৃঙ্কলার সহিত রাজ্য শাসনে সক্ষম ছিলেন। তাহাদিগকে নগন্যসংখ্যক উপজাতি বলিয়া ধারণা করা যায়না। তাহারা কি প্রকার বিপর্যয়ের মুখে পতিত হইয়া, বর্তমান অবস্থায় উপনীত হইতে বাধ্য হইয়াছেন এবং তাহাদের পূর্বাবস্থা কিরুপ ছিল ও কোন জাতি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া বর্তমান স্বপ্ল সংখ্যায় ও অনুন্নত পর্যায়ে পরিণত হইয়াছেন, ইহাই প্রতিপাদ্যের বিষয়।

    ১৩৩৩ খৃষ্টাব্দে ( ৬৯৫ মঘী ) ব্রক্ষ্মদেশীয় রাজা মেঙ্গাদি উত্তর ব্রক্ষ্মের চাকমা রাজা অরুণ যুগের ( ব্রক্ষ্মবাসীরা বলে ইয়ংজ ) রাজধানি মনিজগিরি আক্রমন করিলে, ব্রক্ষ্মরাজ লক্ষাধিক সৈন্য যুদ্ধে নিযুক্ত করা সত্বেও সম্মুখ সংগ্রামে সাহসী না হইয়া বিশ্বাস ঘাটকতার কুটকৌশলের আশ্রয় নিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

    ইতিহাস দৃষ্টে ইহাও প্রমাণ পাওয়া যায় ১১১৮/১৯ খৃষ্টাব্দে ( ৪৮০ মঘী ) ক্ষমতাসম্পন্ন ব্রক্ষ্মের পেগু সম্রাট আলংছিসুর বিরুদ্ধে দুঃসাহসী চাকমারা বাঙ্গালী সহ সম্মিলিত হইয়া উপুর্যপুরি দুইবার বিখ্যাত পেগু সাম্রাজ্য বিদ্ধস্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এই বাঙ্গালী কাহারা তাহার কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ঐ সময়ে সপ্তম শতাব্দী হইতে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উপর বিপ্লবের পরবর্তী অবস্থায় পুনঃ ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের শুরু হয়। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে ঐ বিপ্লবের অবসান ঘটে। ঐ বিপ্লবে ভাগ্য বিপর্যয়গ্রস্থ বৌদ্ধেরা বিধর্মীর অত্যাচার ও নিপীড়নে তাহাদের প্রাচীন সভ্যতা ও গৌরব হারাইয়া বিভিন্ন দিকে পলাইয়া পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন  হইয়া জীবন রক্ষা করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ঐ সময় হিন্দুদের কোন কোন রাজারা আসাম ও কামরুপ প্রভৃতি স্থানে রাজ্য বিস্তার করেন। কামরুপ ছিল তখন আসামের ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্ম প্রবর্তনের এক কেন্দ্র স্থল। ঐ সময়ে হয়ত কোন হিন্দু রাজা ব্রক্ষ্মদেশীয় চাকমাদের সহিত মিলিয়া পরোক্ষ আরাকানে ভারতীয় উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করিয়াছিলেন। অথবা চাকমারা ঐ সময়ে ব্রক্ষ্মদেশে স্বীয় আধিপত্য বজায় রাখিবার বিষয়ে সন্দিহান হইয়া বিদেশীয় বাঙ্গালীদের সাহায্য গ্রহণ করিয়াছিলেন।

    দ্বাদশ শতাব্দীর পর বৌদ্ধ পাল রাজাগণ হীনবল হইয় পড়েন। তৎপরবর্তী অবস্থায় সেন রাজারা ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্ম নিয়া প্রবল হইয়া উঠেন। ঐ বিপ্লবে বহু বাঙ্গালী বৌদ্ধ নেপাল, তিব্বত ও চট্টগ্রাম হইয়া আরাকানের দিকে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ঐ সময়ে নবম শতাব্দীতে গড়িয়া উঠে চট্টগ্রামে ‘‘ পণ্ডিত বিহারের” গৌরবময় স্মৃতি। ইহাতে মনে হয় বহু বাঙ্গালী বৌদ্ধ আরাকানের  চাকমা রাজার আশ্রয় নেন। কারন তাহারা বৌদ্ধ ছিলেন। সম্ভবত উক্ত বাঙ্গালীগণ সহ চাকমারা পেগু সাম্রাজ্য আক্রমনে ব্রক্ষ্মদেশীয় রাজার প্রতিদ্বন্ধী হইয়াছিলেন। চাকমার প্রাচীন ইতিহাসে জানা যায় ঐ সময়ে ব্রক্ষ্মের চাকমা রাজা সাকালিয়ার সময় সেনাপতি বাঙ্গালী সর্দারের অধিনায়কত্বে ঐ যুদ্ধ ১১১৮ খৃষ্টাদ্ধে সংঘটিত হইয়াছিল। সেই সময় ব্রক্ষ্মদেশে তাহারা উন্নত ও প্রভাবশালী জাতি না হইলে পেগু সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিগ্রহে সাহসী হইতেন না।

    ইহার ১৫০ বৎসর পূর্বে ঐতিহাসিক প্রমাণে আবার প্রমাণ পাওয়া যায়, ৯৯৪/৯৫ খৃষ্টাদ্ধে আরাকানের প্রবল রাষ্ট্র বিপ্লবের সময়ে চাকমাদের সাহায্যে ন্যা-সিং-ন্যা-তৈন আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইতিহাসের সাথে বিজড়িত ঐসব উল্লেখিত ঘটনা চাকমারা অতীতে ব্রক্ষ্মদেশে প্রভাবশালী জাতিরুপে পরিচয়েরই পরিপূর্ণ প্রতিফলন। এক সময়ে চাকমাদের প্রাধান্য সময়ে বাঙ্গালী ও বড়ুয়া মিলিয়া ব্রক্ষ্মদেশে এক মিলনক্ষেত্র রচনা করিয়াছিলেন। চাকমা রাজা বুদ্ধাংগিরির মন্ত্রী ছিলেন বাঙ্গালী। বুদ্ধাংগিরির সময় কাল ছিল অনুমান দশম শতাব্দী। পঞ্চদশ শতকে চাকমা রাজা জনুর প্রধান সেনাপতি ছিলেন বড়ুয়া। ১৫৯৮ খৃষ্টাব্দে তিনি তঙ্গু ও শ্যাম যুদ্ধে চাথোয়াই বড়ুয়াকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন।

    চাকমা ভাষা মিশ্রিত ভাষা। ইহাতে বাঙ্গালা , সংস্কৃত, আসামী ও মাগধীর প্রাকৃত ছাপ বর্তমান। তাহা হইলেও বাঙ্গালা ভাষার সাথে এমন সামঞ্জ্যস্য রহিয়াছে যে, ইহাকে বাঙ্গালা ভাষার অপভ্রংশ বলা চলে। চাকমারাই যে বাঙ্গালীদের অধিকতর সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন ইহাতেই বুঝা যায়। অথবা চাকমাদের আদি বাসস্থান এমন ক্ষেত্রে ছিল যাহাদের ভাষা বাঙ্গালার অনুরুপ ছিল এবং ইহাতে ইহাও ধারণা করা যায়, চাকমারা আদি বাসস্থান হইতে ক্রমে ক্রমে বহু দেশ দেশান্তারে বসতি স্থাপন করিয়া, ঘুরিয়া ফিরিয়া চলিয়া আসিতেছেন। এখনও দেখা যায় এই স্বপ্ল সংখ্যক চাকমার মধ্যেও অনেকে পার্বত্য ত্রিপুরা ও লুসাই হিলে স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত হইয়া ক্রমে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইতেছেন। শতাধিক বৎসর পরে হয়ত পরস্পরের ভাষাও বুঝা যাইবেনা। যেমন বর্তমান ব্রক্ষ্মদেশের ছাক (  Task of Thek ) ও দৈননাকদের সঙ্গে চাকমাদের ভাষাগত পার্থক্য সৃষ্টি হইয়াছে। অতীতে ব্রক্ষ্মদেশে তাহারা একই চাকমা জাতিরুপে পরিচিত ছিলেন।

    চাকমা জাতির ইতিহাস হইতে জানা যায় চাকমাদের আদি পিতৃভূমি ছিল চম্পকনগর। তবে ৩/৪টি চম্পক নগরের অবস্থান সম্পর্কে আমরা শুনিতে পাই। তম্মধ্যে উত্তর ব্রক্ষ্ম(শান) প্রাচীন মগধ বর্তমান বিহার, কালাবাঘা ( বর্তমান শ্রীহট্ট ),প্রাচীন মালাক্কা ( বর্তমান মালয় ),কোচিন চীনের চম্পা ও হিমালয়ের পাদদেশস্থ প্রাচীন সাংপু নদীর ( বর্তমান ব্রক্ষ্মপুত্র )তীরবর্তী  আরেক অঞ্চল। কাজেই কোন চম্পকনগর হইতে  তাহাদের আদিপুরুষ বিজয়গিরি ব্রক্ষ্মদেশে উপনীত হন তাহাতে বিভিন্ন মতবাদ দৃষ্ট হয়। চাকমা সমাজের অনেকেই ধারণা করেন প্রাচীন মগধ বা উত্তর বিহারের বর্তমান ভাগলপুরের নিকটস্থ স্থানে অতীতে যে চম্পারন রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এক সময়ে ঐ চম্পার চাকমা রাজকুমার বিজয়গিরি যুদ্ধের অভিযান নিয়া ব্রক্ষ্মদেশে উপনীত হন। এবং আরাকানস্থ অক্সাদেশ রোয়াং রাজ্য অধিকার করিয়া আর পিতৃরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন নাই।

    চম্পার রাজকুমার বিজয়গিরি প্রতিষ্ঠিত রাজ্যই ছিল ব্রক্ষ্মদেশে প্রথম চাকমা রাষ্ট্র। ‍নিম্ন আরাকানের সাপ্রাইকুল ছিল তাহাদের প্রথম রাজধানী। শেষে তদীয় সৈন্য  ও অনুসর বর্গসহ সকলেই তদ্দেশীয় রমণী বিবাহ করিয়া তথায় উপনিবেশ গড়িয়া বাস করিতে থাকেন।

    অনুরুপ বৃত্তান্ত বৌদ্ধ জাতক সাহিত্যেও উল্লেখ পাওয়া যায়। এক সময়ে জনৈক চম্পা রাজকুমার বহু অনুচরবর্গসহ সমুদ্র পথে তাম্রলিপ্ত ( বর্তমান তমলুক ) হইয়া ব্রক্ষ্মদেশে  ( প্রাচীন সুবর্ণ ভুমি ) রওনা হইয়াছেন। কর্ণেল ফ্রেইরি লিখিত ব্রক্ষ্মের ইতিহাসেও অনুরুপ মতবাদ দৃষ্ট হয়। এক সময়ে বারানসীর ( বর্তমান বেনারস ) কোন রাজপুত্র বহু অনুচরসহ ব্রক্ষ্মদেশে উপনীত হন। পরিশেষে যাহারা স্থায়ীভাবে ব্রক্ষ্মদেশে থাকিতে চাহেন তাহাদের চাক-চেক আখ্যা প্রদান করা হয়।

    আবার চাকমা গেংহুলিরা প্রাচীন লোক সাহিত্যের ( গেংহুলি গান ) গানে চাকমা রাজকুমার বিজয়গিরির সাথে এই রাজকুমারদ্বয় এর সাদৃশ্য বর্ণনা করিয়াছেন।

গানে আছে.....

        অপার পানি সাগর বেই,

        কুল কিনারা দেগা নেই,

        জাতি পুজাততে ( বিজয়গিরি ) ‍ঘি দিল,

        রোঙ্যে দেজত তে হুলেল।

গানে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে চাকমা রাজপুত্র অনুচরবর্গসহ বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিলেন। তারপর তিনি রোয়াং দেশের অনুকুুলে উপনীত হইলে,ঘৃতাহুতি প্রদানে জাতীয় পুজা সমাপন করিলেন। উহা হিন্দুদিগের একটা বিশিষ্ট অনুষ্ঠান ও ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের পরিপোষক। চাকমাদের প্রাচীন লোক সাহিত্যের  গান ও প্রাচীন সংস্কার প্রমাণ করে যে, এক কালে তাহার উপবীত ধারণ করিতেন ও মস্তকে উষ্ঞীষ ব্যবহার করিতেন।

    এইসব প্রাচীন গানের ভাষায় মনে হয় ইহা বাঙ্গালা ভাষার যেন নিকট আত্মীয়। সতীশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয় চাকমা জাতি পুস্তকের এক স্থানে উল্লেখ করিয়াছেন “ চাকমাদের এসব প্রাচীন আচার নীতিতে তাহাদিগের ক্ষত্রিয়ত্ত্বের দাবী কথঞ্চীত পরিমাণে স্বীকৃতব্যও বটে”।

    R.H.Hutchinson '' An account of Chittagong Hill Tracts" গ্রন্থের ৮৯ পৃষ্টায় উল্লেখ করিয়াছেন "The Tribes conder themselves descendants  of emigrants from Bihar who came over and setteled in this parts in the days of the Aracanise King" 

এইসব বিভিন্ন ঘটনার অনুকুলে চাকমাদের আদিপুরুষ বিজয়গিরি ও তাহার অনুচরবর্গ উত্তর ভারত হইতেই আসিয়াছিলেন ইহাই অধিকতর সম্ভাব্য করিয়া তুলে। হয়ত ঐ কারণে চাকমা ভাষার  সাথে প্রাচীন মাগধী ও বাঙ্গালা ভাষার ছাপ বর্তমান।

    বিজয়গিরি ও তাহার অনুচরবর্গ এই দেশে আসিয়া বিভিন্ন শ্রেণীর রমণীর  পাণি গ্রহণে বাধ্য হইয়াছিলেন। ইহাতে বিভিন্ন জাতিয় রক্তের সংমিশ্রণে ও আচার অনুষ্ঠানে ক্রমে ক্রমে তাহাদের সবকিছুর পরিবর্তন ঘটে এবং শতাধিক বৎসরের মধ্যে চাকমারা এক অভিনব জাতিরুপে পরিণত হন। সেই সময় আরাকান ছিল অপেক্ষাকৃত অনুন্নত। ইহাতে তাহাদের আদি জাতিয় বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন থাকা কোন প্রকারে সম্ভব নহে। ঐ কারনে সতীশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয় চাকমা জাতি গ্রন্থের এক স্থানে উল্লেখ করিয়াছেন “ ব্রক্ষ্মদেশে গিয়া তাদের জাতিয় নামটি পর্যন্ত রক্ষা পায় নাই ’’। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই পাবর্ত্য জাতির প্রতি প্রাচীন ইতিহাসে কোন সহানুভুতির পরিচয় নাই। ঐতিহাসিকেরা কেন যে ইহাদিগকে তাহাদের আলোচনা হইতে বাদ রাখিয়াছেন তাহারও উল্লেখ নাই। ঐ কারনে আমরা দেখিতে পাই ব্রক্ষ্মদেশে চাকমা রাজাগণের ঐ দেশীয় নামকরণের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত। ব্রক্ষ্মদেশের প্রভাব চাকমাদের উপর যে প্রগাঢ় ছায়াপাত করিয়াছিল তাহার অপর এক দৃষ্টান্ত দেখা যায়। ব্রক্ষ্মদেশীয় ইতিহাস হইতে আমরা জানিতে পারি এক সময়ে অনুমাণ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তৎকালীন ব্রক্ষ্মদেশীয় রাজা কামরুই সম্ভবতঃ চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মের আচার নীতি পালন করিতে চাহেন নাই বলিয়াই চাকমা রাজা মইচাং ( ব্রক্ষ্মবাসীরা বলে মংছুই ) এর রাজধানী মোজামব্রু  আক্রমন করেন। ইহাতে মনে হয় চাকমারা হয়ত তখনও হিন্দুর ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের আচার নীতি অনুসরণ করিতেন। স্থান কাল ও পাত্র ভেদে অনেক স্থলে ধর্মও বিবর্তিত হয়। ঐ যুদ্ধের মর্মান্তিক পরাজয়ের পরিণামে রাজধানীর পতন ঘটে। তাহাতে ব্রক্ষ্মেদেশে চাকমাদের রাষ্ট্রশক্তি নিতান্ত অবসন্ন হইয়া পড়ে। ইহাতে মনে হয় কালের বহুমুখি প্রভাবে হয়ত তখনও তাহারা একনিষ্টভাবে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করিতে পারেন নাই। যুগে যুগে মানব সমাজে পরিবর্তনের আবির্ভাব ঘটিয়াছে তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই।

    চাকমারা সর্বপ্রথম যে চম্পক নগর হইতে আসুন না কেন, কালের স্রোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, স্থান পরিবর্তন ও ঘটনার বিভিন্ন পর্যায়ে তাহারা ব্রক্ষ্মদেশে এককালে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন তাহা অস্বীকার করা যায় না। অথচ কোন কোন বিদেশিয় গ্রন্থাগার তাহাদের উৎপত্তি মাত্র তিনশত বৎসর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।

    রাঙ্গামাটি প্রদর্শনিতে প্রতি বছর যে সব চাকমার তৈয়ারী কাপড় প্রদর্শিত হয় উহা অতীত যুগের বয়ন শিল্পের েএক প্রামাণ্য নিদর্শন। ঐসব কাপড়ে আলাম হইতে যেসব ডিজাইনের ফুল তুলা হয়, ঐ আলাম কে কবে উদ্ভাবন করিয়াছিল তাহা বোধ হয় বর্তমান চাকমা সমাজের কেহ বলিতে পারিবেন না। যেহেতু প্রাচীন রাধামন ধনপুদির পালা গানে ঐ আলামে প্রদর্শিত ফুলের নাম গুলির উল্লেখ পাওয়া যায়।

    ঐ সব ঐতিহাসিক প্রমাণ ও বিভিন্ন তথ্যের দ্বারা প্রাচীন চাকমাদের মধ্যে আমরা সাক্ষাৎ পাই তাহাদের নিজস্ব বর্ণমালা,ইতিহাস,সাহিত্য,রুপ কথা,ধর্মীয় শাস্ত্র এবং সবকিছু।

    ধৈর্যের সহিত বহু অর্থ, শ্রম এবং সময়ের সৎব্যবহারে কোন যোগ্য ব্যক্তির দ্বারা ইহার সম্বন্ধে গবেষণা করিতে পারিলে এখনো বোধ হয় ঐসব মূল্যবান তথ্যাদি আবিস্কার করার সম্ভাবনা রহিয়াছে। ১৯২০ খৃষ্টাব্দ পুর্বে  মোহেনজোদারো বা পাঞ্জাবের হরপ্পা আবিস্কৃত না হইলে আজ দুনিয়া কি স্বীকার করিত সেই প্রাচীনতম সভ্যতা? মোহেনজোদারো ও হরপ্পা আবিস্কারের পর বিশ্বব্যাপি উপদ্বি করেন প্রাচীন আর্য সভ্যতার পূর্বেও জগতের কাছে প্রাচীন সভ্যতা অন্ধকার পর্যায়ে ঢাকা রহিয়াছিল।

    তাহাদের অতীত ইতিহাস অনুধাবন করিলে জানা যায় ঘটনার কালচক্রে বহু যুদ্ধ বিগ্রহ , বহু স্থান পরিবর্তন এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনায় শুধু ব্রক্ষ্মদেশেই পাঁচ শতাব্দীর অধিকাল পরস্পর বিভক্ত হইয়া বহু স্থানে  স্থিতি লাভ করিয়াছিলেন। ঐ সময়ে বিভিন্ন অবস্থার তাড়নায় বহু উপজাতির সংস্পর্শে আসিয়া স্থান, কাল ও অবস্থা ভেদে তাহাদের আচার, অনুষ্ঠান, প্রকৃতি সবই অনুন্নত শ্রেণীর পর্যায়ে বিবর্তন ঘটে। তাহাদের  যে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহীরুপ লুপ্ত পায় তাহার জন্য বিগত কয়েক শতাব্দীর মাঝ পথে জাতি যে চরম অবস্থায় উপনীত হয় তাহাই প্রত্যক্ষত দায়ী।

    প্রাচীন সেই অজ্ঞাত সভ্যতার যুুগে চাকমাদের ইতিহাসের গতিধারা যাহা ব্রক্ষ্মদেশীয় ইতিহাসে অবিচ্ছিন্ন যোগসুত্রের স্বাক্ষর রহিয়াছে। প্রমাণ সাপেক্ষে ইহার যৎকিঞ্চিৎ তথ্যমূলক কাহিনী আমরা অবগত হইলেও এখনও তাহা আবিস্কার ও গবেষণার অপেক্ষা রাখে। তাহাদের প্রাচীন ইতিহাসের আলো-আঁধারী পথে কহিনীর কত প্রোজ্জল চিত্র যে হারাইয়া গিয়াছে বোধ হয় তাহার সঠিক নির্ণয় আর সম্ভব নাও হইতে পারে। অতীতের বিভিন্ন গতিশীল ক্রমবিবর্তনের সাথে বর্তমানে তাহারা অনুন্নত উপজাতি রুপে পরিচিত হইলেও তাহাদের জাতিয় অস্তিস্ত্বের প্রামাণ্য স্বাক্ষর বিভিন্ন ইতিহাসে রহিয়াছে।

[ বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ সব বই সবসময় পাওয়া যায়না। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা বা আমাদের প্রজম্ম আমাদের চাকমা জাতির ইতিহাস , সংস্কৃতি ,ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে অজানা বিষয়গুলো ব্লগের মাধ্যমে আপনাদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ব্লগ গুলো শেয়ার করবেন আপনাদের ভাই,বন্ধু সকলের সাথে। যেন তারাও জানতে পারে বুঝতে পারে। Ojana-Kishu র ব্লগ থেকে আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ