চাকমাদের মধ্যে কোন ছাঁপা গ্রন্থাদি পাওয়া না গেলেও প্রাচীনতম লোক সাহিত্য বা পালা গান , কবিতা ইত্যাদি অনেক কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। এই গুলি সেকালের সমাজের পরস্পর ভাবের আদান প্রদানের মধ্যে কোন এক সুত্র অবলম্বনে সুখ-দুঃখ , ভাঙ্গন-গড়নের মধ্যে রচিত হইয়াছিল।
এইসব প্রাচীন কাহিনী চাকমা সমাজের গায়ক ‘ গেংহুলি ’ বা গানের পালায় কোন বিবাহ বা শ্রাদ্ধ উপলক্ষে লোক সমাগেমে সারারাত্রি লোকের অবসর বিনোদনে গাহিয়া থাকেন। আর শ্রোতাবর্গ গায়ককে চক্রাকারে ঘেরিয়া বসিয়া নিবিষ্ট মনে গান শুনেন। চাকমা গেংহুলিরা মাত্র একটা বেহালা সম্বল করে ঐ সব গানের আসর জমান। চাকমার পল্লী অঞ্চলে এইসব গানের মাদকতার রেশ এখনও যথেষ্ট বর্তমান।
চাকমাদের সমাজে হির্বেবী বারমাস, লক্ষ্মী পালা , রাধামন ধনপতি পালা ইত্যাদি কে কবে রচনা করিয়াছেন জানা নাই অথচ অবিস্মরণীয় কাল হইতে জাতির এক প্রাচীনতম লোক সাহিত্যের অবদান রুপে এখনও সমাজের তাহা পরম আদরের কাব্য সম্পদ। উদাসী শিবচরণ চাকমা ‘ গোজেন লামা ’ রচনা করিয়াছেন বলিয়া সতীশচন্দ্র ঘোষ মহাশয় চাকমা জাতি ইতিহাসে স্বীকার করেন। কিন্তু অতীতের বিভিন্ন তথ্য আলোচনামূলে সিন্ধান্ত করা যায় শিবচরণ চাকমা তাহার রচয়িতা না হইলেও ঐসব ভাবের প্রাণস্পর্শী গীত তাহারই চির স্মরণীয় অবদান রুপে রচিত হইয়াছিল।
গোজেন লামায় দেখিতে পাই পরম জ্ঞান পিপাসার সাথে শাস্ত্র ভাষা অধ্যয়নের প্রবল আকাঙ্খা ও গোসাই এর চরণ ভজনা করিয়া মনোবাঞ্চাপুরক বিভিন্ন বর ভিক্ষা । গোসাই অর্থে এখানে পরমেশ্বরকেই জ্ঞাপিত করিয়াছেন। কিন্তু বৌদ্ধেরা গোসাই বা গোয়ায় অর্থে ভগবান বুদ্ধকেই জানেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রে ঈশ্বরবাদ সম্পর্কে মতভেদ থাকিলেও সরল গৃহস্থরা ঐ ধর্ম বিশ্বাস হইতে মুক্ত হইতে পারেন নাই।
কাপ্তাই এর নাড়াই পাহাড়ের এক অজ্ঞাত পল্লীতে সাধু শিবচরণ চাকমার জম্ম। শিবচরণ বাল্যকাল হইতেই ভাবুক ছিলেন। তাহার পিতা ধুংগিরি চাকমা ও মাতা ধর্মবী চাকমা। এক সময়ে তাহারা নাড়াই পাহাড় হইতে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে তৈনমুড়ী নদী তীরে আসিয় বসতি স্থাপন করেন। তখন ঐ অঞ্চলের চাকমা রাজা ছিলেন সাত্তুয়া বা পাগলা রাজা। যাহার রাজত্বকালের সময় ছিল ১৬৩৮ খৃ্ষ্টাব্দ। শিবচরনের ভাবান্তর দর্শনে তদীয় পিতামাতা তাহাকে সংসারের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাহাকে সে প্রলোভনে ফেলিতে পারেন নাই। কথিত আছে তাহার উদাসভাব দর্শনে অনন্তর তাহাকে বাধিঁয়া রাখার চেষ্টাও করা হয়। তথাপি তিনি অদৃশ্য শক্তি বলে আপন ইচ্ছায় চলিয়া যাইতেন। আহারের সময় , স্নেহময়ী মাতা তদীয় পুত্রের অদর্শনে তাহার নিমিত্ত ভাতের মৌচা ( পুতলী ) রাখিয়া দিতেন। কিন্ত আচার্যের বিষয় হয়ত কোন সময় তিনি আসিলে ঐ ভাত গরম পাওয়া যাইত। শেষে তিনি গৃহ ত্যাগ করিয়া বাহির হন। তারপর আর কোন সন্ধান মিলে নাই।
ঐ সময়ের রচিত গোজেন লামার পদগুলি অনেক স্থলে চাকমা কথ্য ভাষায় রচিত হইলেও তাহাতে বিকৃতরুপে বাঙ্গালা ভাষার ছাপ যথেষ্ট বর্তমান এবং বিভিন্ন শব্দ প্রয়োগে তার ছন্দ রক্ষা করাও সম্ভব হয়নাই। ইহাতে প্রায় তিন শতাব্দী পুর্বের চাকমা ভাষার গতি ধারা বেশ প্রমাণ করে। তার রচনা সরল ও ভাব প্রবণ।
নিম্নে তাহার ছয় লামা লিপিবদ্ধ করা হইল। লামা শব্দের অর্থ লামা।
প্রথম লামা
উজানি ছড়া লামনি ধার, না আসিল সৃষ্টি জলৎকার।
জল উপরে গর্যে স্থল, বানেল গোজেনে জীব সকল।
আগে সালাম বানেয়ে যার জনম, আগে সালাম দোং তার চরণ।
চানে-সুর্য সদর ভেই, সালাম দোং উদ্দেশ্যে ভূমিত থেই।
সম্মুখে সালাম দোং পুগেদি, পশ্চিমে সালাম দোং পিজেদি।
উত্তরে সালাম দোং বাঙেদি, দক্ষিণে সালাম দোং ডেনেদি।
মরে বিধিয়ে দয়া ওক, তিন দেব চরণত সালাম রোক।
ন বুঝে তিন দেবে সেই সকল, সেই সকল বড় কমল , ফুলকমল।
মা স্বরস্বতী সালামত, যোগেই দি তগোই গীতপদ।
সালাম মানেই তপসী, ধর্মশীলা সন্যাসী।
এগামনে ভজঙর, সালাম জানেলুং দেবসকল।
পুজার গুরু মানেলুং, আজার সালাম জানেলুং।
মত্ত্যে পুরীতে জনম বার, তার চরণে নমস্কার।
দশ মাস দশ দিন দুখ পিয়ে,জম্বু দ্বিবোত নি জম্মেয়ে।
পুরি চেলং চোক ভরি, মা বাপ পারা নেই দেশভরি।
পর বৌয়া বুঝে আগেরে ইঙিদে, এজের মানেই লক সংসারে।
মা বাপ চরণে ভুজিলে,সকল তিথ্য ফল পেবে।
জ্ঞানী-ধ্যানী সালাম দোং,পর বৌয়া পন্ডিত ভুজিলং।
চবারে সালাম মুই দিলুং, গীত সাধনান সাধিলুং।
গীত এক লামা ফুরেয়ে, বুঝেল বুঝিবু মানেয়ে।
দ্বীতিয় লামা
তদাৎ বেরেই ধুব হাপড়, গোজেন চরণত ভজঙর।
আগে সালাম দোং শিবচরন, মাগং গোজেনর দুই চরণ।
চেয়ার তলে রাগে দ, অ হালে তরে দ।
জম্মে জম্মে দেগা ওক, চিদে মনে এগা ওক।
দেবাংশী গোজেনে ন দোষী, অবুঝ মানেয়ে ন বুঝি।
শুন শুন রে পরবোয়া ভেই, দ্বিবা অক্ষরে তরি যেই।
গুরু সাধি ন পেয়ে, অনা গুরুয়ে পার ওয়ে।
সাধ আনং আর জনম, সকল দান গরঙর এই জনম।
জুরি ন পাল্লে কুয়োৎ পেবে,ভুজিলে চরণে কুল পেবে।
ন রলে ধন মান সাধনে, তরিবু মানেয় লোক ফুল দানে।
গুরু চরণ সার করে, বংশ ধনে কি পার করে?
এগামনে ভুজিলে,সকল তিথ্য পায় বেলে।
দয়া দে-লে সার করে,অপার পানি সাগরে।
ত্রিশ তিন জাতি ভাজা পারতুংগৈ অক্ষরে,
ভুজিলে মানেই লোক এই কালে,যমে ন ধুরিবু ঐ কালে।
যে বর মাগে সে বর পায়,গোজেনে বর দিলে ন ফুরায়।
গোজেন মেয়্যে উদ নেই, ভুজি পারিলে দুখ নেই।
পরম বৃক্ষে ভর দিয়া, ভুজি পারে কে তার মেয়্যে?
সকল জীবে বেদায় ওক, চিত্তে মনে এগা ওক।
পরম গোজেনে কিয়ত থায়, সাতবার সাধনে সেই ন পায়।
তদা সাধি আনিব, পরম গোজেনে ভুজিবু।
চরণে সালামে ভুজিলে, ধর্ম সাধনান পায় বেলে।
সালাম দিবার হাজেল, গীত দ্বি লামা ফুরেল।
দ্বি লামা ফুরেলে ন যেবং, গোজেন সম্মুখে বর লবং।
তৃতীয় লামা
তদাৎ বেরেই কাপড়ে, আরাধন গরঙর আতযোরে।
দুখ্যা হুলে যার জনম, তদা সাধঙর পায় জনম।
হীনকুলে ন যেদুং, দুখ্যা কুলে ন অদুং।
আদে ন গত্তুং জীব বধ, যুগে যুগে ন পত্তুং দজগৎ।
পরম বৃক্ষি মোর ন অদ, চিদা চর্জা ন তেদ।
কদা ন কদ তলেদি, লোকে ন কদ কলঙ্খি।
রোগে ব্যাধিয়ে ন দত্ত, অজল নিচ দাত ন অদ।
পরা ন পেদুং ধনেদি, উনা ন অদুংগৈই জনেদি।
অবুঝ জম্ম ন অদুং, তিদা হদা ন শুন্দুং।
কানে ন শুন্দুং কু কদা, পরে ন কদ কু কদা।
পরবোয়া পন্ডিত যে দেশে, জম্ম অদুংগৈই সেই দেশে।
আরনি রাজার দেশ লাগ ন পাং, অগাদি অপদে যেই ন পাং।
যেদক চিদে তায় ন জান্দুং, বেদক পরা ধোরা ন পেদুং।
গীত তিন লামা ফুরেলুং, সভায় হুজুর জানেলুং।
চতুর্থ লামা
তদাৎ বেরেই কাপড়ান, ভুজিলুং গোজেন চরণান।
গীতে রেঙে উল্লাসে, সাধঙর সাধনান কেলাশে।
দুখ্যা জম্ম ন অদুং, সু্খ্যা জম্ম অদুঙগোই।
বাবে এদ গম দিনে, জম্ম দিত সুক্ষেনে।
সাধি গরত আবুজতুং, মন খেলেয়ে খেলেদুং।
জাতে কুলে অদুংগোই, থানে ঠমকে অদুংগোই।
ধর্মী মা বাপ লাগ পেদুং,চিদে শুন্যে মন সুখে দুধ খেদুং।
সাত ভেই সাত বোন লাগ পেদুং, নোনেয়্যে খুলাবোয়া মুই অদুং।
সোনার দুলোনত ধুলেদাক, দেবর ভঙানি ভঙেদাক।
জেত্তা সমারে জেদেঙা,খুড়া সমারে খুড়েঙা।
কালি কুশ্যালে বের বাড়ক, গুত্তি গুদরি ডেইল বাড়ুক।
ধনে জনে অদ মর , ধানে ভরন গোলা ঘর।
সমারে বন্ধ পাং পারা,লোকে কুদুমে সব পুরা।
কদানি অলে মু মিদে, গীতে রঙে গম গলা।
মাধা জোগা চুল ধোরোক, মধুর গা অদ দ্বিবা চোগ।
ভেঙা অদ চোগো ভঙ, মজুঙ দাত্তুন অদ চং।
চেবার গম অদ উত্তানি, গোজেনে বানেদ আত্তানি।
তদা পেদুং দেব গড়ন, বারা অজার বুক ভরণ।
ছানে শিক্যায় গড়নে, রুপে রঙে পিদুং সবখানে।
রাজা বাদায় পান খেদুং, সাধি গরত উবুজতুম।
পড়োয়া পন্ডিত মুই অদুং, দর্যা করলী পায় গণং।
লোকে মাদেদাক আজিয়ে, সর্ব লোকে পুজিদাক।
দেলে শত্রুরে ভজদাক।
হাতে পেদুং লেগা বর, কেয়াৎ পিদুং রুপ বর।
গীত চারি লামা ফুরেই যাই, তদা সাধংর আর বার।
পঞ্চম লামা
তদাৎ বেড়েই হাপড়ান, ভুজিলুং গোজেনর চরণান।
চরণে সালামে ভুজিলে,সকল তির্থ ফল পায় বেলে।
পাঁচ ফুল দান ফল পেদুংগোই, রদে বলে অদুংগোই।
গোজেন সম্মুকে কর পাদং, সাত পুত চেই যদি বর মাগং।
ডেনে মাগং ধন বর, বামে মাগং জন বর।
ধন সম্পদে সব পুরা,জুরি পাত্তুংগোই এৎ গোড়া।
যে বর মাগঙর মনের সাধ, সেই বর পেদুংগোই আদে আদ।
হাল্যা আবুজিলে লেই সাধি, জুম্মোয়া আবুজিলে তং সাধি।
দেবান আবুজিলে বীর সাধি, রাজা আবুজিলে চক্রবর্তী সাধি।
কেয়াৎ পেদুং সাজানা, ত্রিশ তিন জাতিত্তুন পেদুংগোই খাজানা।
খাদে পালংঙে ব খেদুং, ত্রিশ তিন জাতি ভাই মুই পাত্তুং।
যে বর মাগঙর মনের সাধ, সে বর পেদুং আদে আদ।
গীত পাঁচ লামা ফুরেই যার, তদা সাধঙর আর বার।
ষষ্ঠ লামা
তদাৎ বেরেই কাপড়লোই,গোজেনে ভজঙর গুজি হই।
মাতা পিতার ভক্তি লং, সাত ভেই সাত বোন বর মাগং।
আদে ঢালি পানিরে,দিব মা স্বরস্বতী স্বাক্ষীয়ে।
এগার আজার চুরাশি সন, ফলনা যারে সাধঙর এগামন।
চরণে সালামে ভজঙর, যেবার মেলানি মেলঙর।
গীত ছয় লামা ফুরেয়ে, বুঝিলে বুঝিবু মানেয়ে।
দেবর কুলে দেব মানাই, মানেই কুলে লোক মানাই।
হুদু গেলা সঙ্গী ভেই,সাধি সমারে চলি যেই।
ফুরেয়ে ছয় লামা শেষ অল, গোজেন চরণত মন রল।
[ শ্রীযুক্ত বিরাজ মোহন দেওয়ান লিখিত ‘ চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত ’ থেকে তৃতীয় পরিচ্ছেদ হতে গোজেন লামা বা গোঁসাই পালা চাকমা জাতির প্রাচীন লোক সাহিত্যটি ভবিষ্যৎ প্রজম্মের জন্য ব্লগ আকারে রাখা হল। আপনি জানুন এবং অন্যকে জানার জন্য শেয়ার করুন। ]
Ojana-Kishu ব্লগ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
0 মন্তব্যসমূহ