বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উচু, নীচ পর্বতবহুল বিভিন্ন জাতির অধ্যুষিত জেলা এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যই ইহার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নদ নদী শোভিত আর গিরি বনরাজি পরিবেষ্টিত এই জেলা বিভিন্ন জাতিদের সুদীর্ঘ কালের বাস স্থান প্রাকৃতিক সৌর্যের এক লীলাভূমি।
চাকমা, মগ, মুরং, ত্রিপুরা, রিয়াং, খিয়াং , বনযোগী, কুকি , তঞ্চাঙ্গ্যা, চাক , পাংখো, খুমি প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির সমাবেশে এই পার্বত্য জেলায়। তার মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ট। অনুসন্ধিৎসু মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে চাকমাদের আদি বাস স্থান কোথায় এবং তাহারা কি এই জেলার অধিবাসী ? সুদুর ব্রক্ষ্মদেশ , আরাকান চম্পক নগর, আলিকদম , পার্বত্য ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানের সহিত স্মরাণাতীত কাল হইতে ঘটনাবহুল বিবিধ অধ্যায়ে চাকমারা যথেষ্টরুপে ঐতিহাসিক কাহিনীর সহিত জড়িত ও সংশ্লিষ্ট।
চাকমাদের আদি পরিচয় ভিত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ দৃষ্ট হয়। তাহাদের বিভিন্ন প্রাচীন তথ্য ও চাকমা সম্পর্কে রচিত ঐতিহাসিক বিবরণ হইতে জানা যায় এক সময়ে চম্পকনগর হইতে চাকমা রাজকুমার বিজয়গিরি দিগ্বিজয় মানসে চট্টগ্রাম ও আরাকান অঞ্চলের মগ, মুরুং প্রভৃতি পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলে অভিযান করেন। ইহার পর কয়েক শতাব্দী অতীত হইলে ঘটনা বিপর্যয়ক্রমে বিগত চতুর্দশ শতাব্দীতে আবার চট্টগ্রামে প্রবেশ করেন । আদতে তাহারা এই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী নহেন। প্রাচীন বেদ শাস্ত্র গ্রন্থাদির দ্বারা যেইরুপ প্রাচীন যুগের সভ্যতা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিধির পরিচয় পাওয়া যায় চাকমা জাতির সেইরুপ কোন নিদর্শন হইতে কোন পরিচয় লাভের উপায় নাই - যে পর্যন্ত না তাহারা কোন জাতি বা দেশ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া এই ব্রক্ষ্ম দেশে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিলেন তাহা জানা নায়।
চাকমা জাতি সম্পর্কে ইতিহাস রচিত হইলেও এই পুস্তকে বহু গ্রন্থগারের বিভিন্ন যুক্তি উপস্থিত করতঃ চাকমা জাতি পরিচয়ে গ্রন্থকারগণ যে সিন্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন তাহার বর্ণনা প্রদর্শিত হইল। ইহাতে জাতির পরিচয়ে তাহারা কোন সঠিক লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ না পাওয়াতে উহা আবিস্কারের চেষ্টা সত্বেও কেহ সঠিকভাবে নির্ণয় করিতে পারেন নাই। প্রায়ই গ্রন্থাকারগণ তাহাদের বাহ্যিক আচরণ নীতি, ভাষা , স্থানের অবস্থিতি, নানা জনশ্রুতি ও শরীরের গঠন ইত্যাদি নিয়া নিজ নিজ মন্তব্য সমর্থনের প্রয়াস পাইয়াছেন।
অতীতে চাকমারা ব্রক্ষ্মদেশে আসিয়া চাক-চেক বা চাংম্যাং এই নামে আখ্যাত হন। দেশ,কাল ও অবস্থাভেদে সমস্তই পরিবর্তীত হইতে বাধ্য। ইহাতে অনেকে অনুমাণ করেন এই ক্ষেত্রেও চম্পক নগর হইতে আগত লোকদের ব্রক্ষ্মদেশে চাক-চেক চাকমা এই নামে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ভাষাগত পার্থক্য হইতে উচ্চারণের বিভিন্নতা প্রকাশ পায়। তদ্রুপ চম্পক হইতে চাম্পা এবং চম্পা হইতে চাকমা হইয়াছে। এখন যেমন অনেক সাধারন বাঙ্গালীরা চাকমাদের চাম্মুয়া ডাকিয়া থাকে। সেইরুপ ব্রক্ষ্মদেশ, লুসাই হিল ( মিজো হিল ) প্রভৃতি স্থানে তাহারা অতীতে ঐ চাক-চেক-চাকমা নামেই পরিচিত ছিলেন। ব্রক্ষ্ম ইতিহাসের পূর্ববর্তী সময়ে ঐ নামে পরিচিত জাতির কোন গ্রন্থ বা নিদর্শন পাওয়া যাইবেনা। অথচ ইহারও সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তাহারা ব্রক্ষ্মবাসী বর্মী নহেন।
রাষ্ট্র বিপ্লব , ধর্ম বিপ্লব ইত্যাদি নিষ্পেষনের কালচক্রে পড়িয়া ভারতের কত জাতি যে অপর জাতির সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে , তাহা নির্ণয় করা সম্ভবপর নহে। ক্ষুদ্র-বৃহৎ বহু জাতির ঐসব কারণে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করাও সম্ভব হয় নাই। প্রাচীন ভারতের দীপ্তিমান বৌদ্ধ যুগের ইতিহাসই ইহার উজ্জল দৃষ্টান্তরুপে উপস্থিত করা যায়। যুগে যুগে ইতিহাসই স্বাক্ষীরুপে জাতিকে স্মরণ করাইয়া দেয় তাহার অতীতের উত্থান পতন ও রাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন বিচিতও খবর, বৌদ্ধ যুগের সেই মল্ল , লিচ্ছবি, বৃজি, শাক্য প্রভৃতি বৌদ্ধ ধর্মের উজ্জীবনকারী জাতিদের মহাকালের কাল চক্রে আজ আর কোন অস্তিত্বই খুঁজিয়া পাওয়া যায়না। সুতরাং চাকমাদের ন্যায় অনতিবৃহৎ জাতির পক্ষে এইভাবে জাতিয় বৈশিষ্ট্য হারাইয়া ফেলা বা সম্পূর্ণ বিলোপ প্রাপ্ত হওয়া ও অসম্ভব নহে।
চাকমার প্রাচীন জাতীয় ইতিবৃত্তের তথ্যমূলে জাতি সম্পর্কে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ হইতে অবগত হওয়া যায়, তাহারা উত্তর ভারত ও ব্রক্ষ্মপুত্র নদের উপত্যকায় এক সময়ে শাসন চালান এবং সেইখান হইতে হইতে ক্রমশঃ দক্ষিণে রাজ্য বিস্তার করেন। এক সময়ে আসামের কালাবাঘা নামক স্থানে তাহার গতি কিছু কালের জন্য স্থগিত ছিল। কালক্রমে তাহারা আবার উত্তর দিকে ফিরিয়াছেন কিনা তাহার হদিস পাওয়া যায় নাই। তবে পরিশেষে ঐ অঞ্চলের চম্পক নগর হইতে এক বিশেষ ক্ষেত্রে যুদ্ধের অভিযান নিয়া তাহারা কিভাবে দক্ষিণ অঞ্চলের পাহাড়ি জাতিগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করেন ও কালক্রমে বিজয়গিরির পরবর্তী রাজা সিরত্তমা চাক এক সময়ে রাজ্যের পরিধি বিস্তার করিয়া আদর্শ রাজারুপে ব্রক্ষ্মে কীর্তীত হন তাহা এখনও ইতিহাসে এক সরস কাহিনীরুপে বিবৃত রহিয়াছে।
উক্ত অভিযানে যদিও দুই বা ততোধিক যোগ সুত্রের সন্ধান পাওয়া যায় কিন্তু পারিপাশ্বিক ঘটনা ও বিভিন্ন ভৌগলিক অবস্থানের প্রমাণে উল্লেখিত উত্তর ভারতের সুত্রই উক্ত যুদ্ধের ঘটনার প্রত্যক্ষ নিদর্শনরুপে গ্রহণযোগ্য। হয়ত অবস্থার তাড়নায় তাহারা দুই অংশে বিভক্ত হইয়া , দুইটা শাখা বিস্তার করিয়াছিলেন। ইহাতে বিজয়গিরির অভিযানে ভৌগলিক সংযোগ সুত্র, যদিও ঐতিহাসিক কার্যকরণ হইতে বিচ্ছিন্ন নহে কিন্তু জনচিত্তে ইহা এক ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করিয়াছে।
এই ক্ষেত্রে চাকমাদের মধ্যযুগের পরবর্তী কাল হইতে ব্রক্ষ্মে অবস্থিতির যেমন ঐতিহাসিক প্রমাণ রহিয়াছে, অনুরুপ পার্শ্ববর্তী কোচিন, চীন, শ্যাম,উত্তর ব্রক্ষ্মের দৈননাক-দের বর্ণমালার সাথে বর্তমান চাকমাদের বর্ণমালার সৌসাদৃশ্য থাকায় আর এক গভীর গবেষণা মূলক অনুসন্ধানের অপেক্ষা রাখে। আর ব্রক্ষ্ম ইতিহাসই প্রমাণ করে দৈননাক রা জাতিতে চাকমা।
[ চাকমাদের জাতীয় পরিচয় সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। জাতীগত পরিচয় জানা সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই আমাদের প্রজম্মকে জানানো দরকার। যদি অন্যদেরকে জানাতে চান তাহলে ব্লগটি শেয়ার করা অত্যন্ত জরুরী। এতে আপনি ,প্রজম্ম এবং সবাই উপকৃত হবে। ]
Ojana-Kishu র ব্লগ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
0 মন্তব্যসমূহ