Click On Ads

Ticker

6/recent/ticker-posts

চাকমা জাতির শ্রেণী বিভাগ

         ব্রক্ষ্মদেশে চাকমারা যে কয়েক শতাব্দী অবস্থান করেন ইহাতে বিজয়গিরির অনুপরবর্তী রাজা সিরত্তমা চাকের সময়ে যে রাষ্ট্র শক্তি নিয়া রাজ্যের পরিধি বিস্তার লাভ করে পরবর্তী রাজাগণ ঐরুপ প্রভাব বিস্তার করিতে সক্ষম ছিলেন না। ইহাতে দেখা যায় সিরত্তমা চাকের পরবর্তী সময় হইতে প্রায় একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তাহারা বার বার হৃত রাজ্য উদ্ধার করার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। ইহার মধ্যে ৯৯৪ ‍খৃষ্টাব্দে আরাকানের রাষ্ট্র বিপ্লব  ও ১১১৮ খৃষ্টাব্দে বাঙ্গালী সহ সম্মিলিত যুদ্ধের ঐতিহাসিক স্বাক্ষর পূর্বেই উল্লেখ রহিয়াছে। ইহা ছাড়া চাকমার বিজগে রাজা কমল চেগের সময় তাহারা পুনঃ আরাকানে গিয়া ‍যুদ্ধ করার বিষয় উল্লেখ রহিয়াছে।



    ঐ সময়ের বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীর ও তথ্যাদির নিরপেক্ষ সুত্রের ইতিহাস পাওয়া যায়নাই। দেঙ্গাওয়াদি আরেদফুং বা আরাকানের ইতিহাসে যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহার দৃষ্টি পরিপূর্ণরুপে প্রকাশ নাই। ‍তবে ত্রয়োদশ খৃষ্টাব্দ হইতে ঐতিহাসিক প্রমাণগুলি ধারাবাহিকরুপে সমস্যাগুলির অনুধাবন করা যায়।

    ব্রক্ষ্মদেশীয় রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে বার বার সংঘর্ষে, বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক স্থান পরিবর্তন প্রভৃতি বিভিন্ন পরিস্থিতি উদ্ভবের কারণে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝপথে জাতির যে ভাঙ্গন শুরু হয়, তার পরিণতির ফলে তাহারা ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে ব্রক্ষ্ম দেশ ত্যাগ করিতে বাধ্য হন। ইহাতে মনে হয় বক্ষ্যমান জাতির একটা বিশেষ অংশ হয়ত সেখানেই রহিয়া গিয়াছে।

    ১৩৩৩ খৃষ্টাব্দে চাকমা রাজা অরুণ যুগ রাজা মেঙ্গাদির নিকট পরাজিত হইলে তিনি ১০,০০০ চাকমা সৈন্য বন্দী করেন। পরিশেষে তাহাদের সামরিক পেশা পরিত্যাগ করাইয়া দৈননাক পরিচয়ে নিজ রাজ্যে বসবাস করিতে অনুমতি প্রদান করেন। তাহারা চাকমা জাতির একটা বিচ্ছিন্ন অংশ হইলেও বর্তমানে ভিন্ন নামে পরিচিত। মগ ভাষায় দৈন অর্থ ঢাল (Shield ) আর নাক অর্থে ধারনকারী ( Holder ) । অর্থাৎ ঢাল ধারনকারী বা যোদ্ধা। কিন্তু অনেকে এই দৈননাক বা তঞ্চঙ্গাদের পৃথক রুপে পরিচিত করিলেও উভয় সম্প্রদায় মূলতঃ এক এবং চাকমা জাতির একটা বিশেষ অংশ। তাহারাই আরাকানে রোয়াঙ্যা বা তঞ্চঙ্গা নামে পরিচিত। বান্দরবানে বা এই জেলার বিভিন্ন অংশে এবং আরাকানে যেসব তঞ্চঙ্গা আছেন, তাহারা আদতেই চাকমা জাতির একটা বিশেষ অংশ। এক সময়ে আরাকান হইতে পুনর্বাসনের সময় যেসব চাকমা সেখানে রহিয়া গেলেন, তাহারা শেষে রোয়াঙ্যা চাকমা নামে খ্যাত হন। আরাকানে এ সমুদয় রোয়াঙ্যা চাকমাগণ বর্তমানে বহু ভু-সম্পত্তির অধিকারী এবং শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটা উন্নত হইয়াছেন। জানা যায় আরাকান রেজিমেন্টে তাহাদের অনেকে উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার রহিয়াছেন।

    ঐ সময়ে যাহারা চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে চলিয়া আসেন , তাহারা আনক্যা চাকমা নামে খ্যাত হন। এই বিষয় চাকমা জাতি গ্রন্থকার সতীশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয় ও শ্রীশ্রীরাজনামা গ্রন্থকার উভয়েই একই মতবাদ প্রচার করেন। ইহা কেবল আরাকনিদিগের প্রদত্ত নাম।ঐ দৈননাক নামীয় চাকমারা শেষে রাজা মেঙ্গাদির রাজ্যে বিভিন্ন জাতির সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করিতে বাধ্য হয়। তাহাতে ক্রমে তাহাদের সংখ্যা বৃদ্ধি লাভ করা স্বাভাবিক। বর্তমানে ঐ দৈননাক সম্প্রদায়ের সহিত  বর্তমান চাকমাদের আচার ব্যবহার ইত্যাদির যে বিলক্ষণ পরিবর্তন ঘটিয়াছে তাহা বলা বাহুল্য মাত্র। আরাকান সীমান্তের বাইছড়ি মৌজার হেডম্যান শ্রীযুক্ত সুথায়প্রু চাক মহাশয় বলেন যে, মাঝে মাঝে আরাকান সীমান্তে তাহাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ ঘটে এবং তাহারা এখনও নিজেদের চাকমা বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। কিন্তু কর্ণেল ফ্রেইরী সাহেব ইহাদের এক ভিন্ন জাতি হিম বা নাগা নামে পরিচয় করিতে চাহিয়াছেন। ক্যাপ্টেন লুইন এই বিষয়ে প্রতিবাদ করিয়াছেন। সতীশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয় ও Resly সাহেব চাকমা দৈননাক ও তঞ্চঙ্গাদের মূলতঃ একই চাকমারুপে মত ব্যক্ত করিয়াছেন। Provincial Gazetteers of India গ্রন্থের ৪১০ পৃষ্ঠায়ও অনুরুপ চাকমা দৈননাক ও তঞ্চঙ্গাদের একই জাতিরুপে উল্লেখ করা হইয়াছে।

    চট্টগ্রামের লোকেরা দক্ষিণ অঞ্চলের লোকদের আনক্যা বলিয়া থাকেন। সাতকানিয়া, রামু প্রভৃতি অঞ্চল হইতে যেসব মল্লবীর ( বলী ) কুস্তি খেলার জন্য চট্টগ্রামে আগমন করিতেন, তাহাদেরও আনক্যা বলী আখ্যা এখনও রহিয়া গিয়াছে। ইহাতে দেখা যায়, ঐ আনক্যা শব্দটি স্থান বিশেষের উপর প্রযোজ্য হইয়াছে। পূর্বে আরাকান ও তৎসীমান্তের অঞ্চলকে রোয়াং দেশ বলা হইত এবং ইহাতেই ঐ অঞ্চলের চাকমাদের রোয়াঙ্যা চাকমা বলা হইয়া থাকে।

    এক সময়ে চাকমারা ব্রক্ষ্মদেশ হইতে আসিয়া প্রথমেই তৈনছড়ি নদী তীরে বসতি স্থাপন করেন আর ঐ তৈন শব্দ হইতে ক্রমে ক্রমে তাহারা তঞ্চঙ্গা নামে পরিচিত হন বলিয়া এইরুপ একটা প্রবাদ রহিয়াছে। আবার মগ ভাষায় টং অর্থ পাহাড়, ঐ টং শব্দ হইতে তঞ্চঙ্গা নামে পরিচিত হওয়ার বিষয়ও অনেকে অনুমান করেন। যেহেতু তাহারা পাহাড়ের উপর চাষ করিতেন এবং পাহাড়েই গ্রাম রচনা করিতেন।

    বর্তমানে দক্ষিণের তঞ্চঙ্গারা নামের শেষে চাকমা তঞ্চঙ্গা অথবা কেবল চাকমা লিখিয়া থাকেন। যেমন ২৬৮ নং রেজু মৌজার হেডম্যানের নাম শ্রীযুক্ত মেয়ং চাকমা তঞ্চঙ্গা। আর তুম্বরু মৌজার হেডম্যানের নাম শ্রীযুক্ত কেজলয় চাকমা। এইভাবে দেখা যায় দক্ষিণের তঞ্চঙ্গারা সকলেই নামের শেষে চাকমা তঞ্চঙ্গা অথবা কেবল চাকমা লিখিয়া থাকেন। যেমন চাতাউ চাকমা, মংক্যজই চাকমা, উইলা চাকমা, সৗরিল্যা চাকমা ইত্যাদি। নামগুলি অধিকাংশই মগের অনুকরনে রাখা হইয়াছে। আর আচার পদ্ধতিও তাহাদের কিছু পরিবর্তন ঘটিয়াছে। বর্তমানে তাহাদের মগদের মত লুঙ্গিই পুরুষদের পোষাক।

    আবার চাকমা সার্কেলের তঞ্চঙ্গারা নামের শেষে চাকমা উল্লেখ করেননা। তাহারা নামের শেষে তঞ্চঙ্গা লিখিয়া থাকেন। যেমন সুরেন্দ্র তঞ্চঙ্গা,  কাশীরাম তঞ্চঙ্গা, দীননাথ তঞ্চঙ্গা ইত্যাদি। ইহাতে দেখা যায় দেশ কাল ও সময়ের ব্যবধানে সবকিছুর পরিবর্তন অনস্বীকার্য।

    ক্যাপ্টেন লুইন এক স্থানে আবার দৈননাক ও তঞ্চঙ্গাদের ভিন্ন জাতি রুপে পরিচিত করার চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু সতীশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয় ঐ বিষয়ে বিরুদ্ধ মত প্রকাশে তাহার প্রতিবাদ করিয়াছেন। অপর গ্রন্থকার মাধব চন্দ্র চাকমা মহাশয়ের শ্রীশ্রীরাজনামা পুস্তকে আরাকানস্থ তঞ্চঙ্গা ও দৈননাকদের একই চাকমা জাতিরুপে মন্তব্য করিয়াছেন।

    অতীতের দেশ দেশান্তরের বিভিন্ন কাহিনীর সঙ্গে জড়িত হইয়া যদিও উভয় সম্প্রদায়ের নাম ও আচার পদ্ধতির বিলক্ষণ পরিবর্তন ঘটিয়াছে কিন্তু মূলতঃ একই চাকমা জাতিরুপে তাহারা পরিচিত। ধর্ম বিশ্বাসেও তাহারা একই ধর্মের অনুসারী। এইভাবে চাকমারা দেশ কাল ও সময়ের ব্যবধানে পৃথক জাতি বা সম্প্রদায় রুপে পরিণত হইতে চলিয়াছেন।

    এই জেলার বান্দরবান প্রভৃতি অঞ্চলে বিলীয়মান যেসব চাক জাতির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তাহারা পোষাক প্রভৃতি ও আচার অনুষ্টানে অনেকটা মগদের অনুকরনে অভ্যস্থ হইয়া পড়িলেও বিভিন্ন প্রমাণে ও যুক্তির সমর্থনে তাহাদের চাকমা সমাজ হইতে পৃথক করা এক প্রকার অসম্ভব।

    স্যার R.H রিসলী মহোদয় এই ছাক-ছাকমা-চাকমাকে একই রুপে মূল নির্দেশ করিয়াছেন। ছাকদের আচার ব্যবহার চাকমাদের সহিত নানা স্থলে বিভিন্ন হইলেও মূলতঃ সাদৃশ্য অস্বীকার করা যায়না। এই ছাক নামটি যেন চাকমা নামেরই রুপান্তর মাত্র।

    বর্তমান নাইক্ষ্যং ছড়ি মৌজার হেডম্যানের নাম শ্রীযুক্ত মং চোথায় চাক। তিনি শিক্ষিত ব্যক্তি। বাইছড়ি মৌজার হেডম্যান শ্রীযুক্ত সুথায় প্রু চাক। এই জেলায় এই দুই জন চাক হেডম্যান চাক আছেন। তাহারা বলেন তাহাদের ভাষা মগ ভাষা হইতে পৃথক এবং বিকৃত রুপে কোন কোন শব্দ চাকমা ভাষার সাথে যথেষ্টরুপে মিল রহিয়াছে। গত ১৯৬৬ ইং রাঙ্গামাটিতে হেডম্যান দরবারের সময় উক্ত দুই হেডম্যান আগমন করেন। ঐ সময় তাহাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় তাহাদের চুগলাং, গাং পুজা, মৃত ব্যক্তির শবদাহ প্রভৃতি সামাজিক প্রথাগুলি চাকমাদের সাথে সাধারন গড়মিল দৃষ্ট হইলেও মূলত সাদৃশ্য অস্বীকার করা যায়না। বহুকাল যাবৎ আরাকান ও মগদের অঞ্চলে তাহারা অবস্থান করার ফলে আচার অনুষ্টান এবং পুজা পার্বনে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই জেলায় তাহারা মাত্র দুই সহস্রাধিক লোক আছেন। বাই ছড়ি মৌজার হেডম্যান বলেন- তাহাদের পূর্ব পুরুষরা একই চাকমা রুপে আরাকানের চা-কিং-ব্রা নামীয় স্থানেই ছিলেন। চাকমাদের পিড়া ভাঙ্গা গোষ্ঠীর মধ্যে একটা সংস্কারের কারনে অনেকে যেমন মিষ্টি কুমড়া বীজ বপন করেনা, তাহাদের মধ্যেও ঐ সংস্কারের বশবর্তী হইয়া এখনও ঐ মিষ্টি কুমড়া বীজ বপন করেনা। তিনি ঐ সংস্কারের কারণটি অনর্গল বলিয়া গেলেন। বর্তমানে আরাকান অঞ্চলে তাহাদের কিছু লোক থাকিলেও অনেকে আরাকানিদের সাথে মিশিয়া গিয়াছে বলিয়া তিনি বলেন। যেহেতু বহুকাল মগদের সাথে আত্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া পৃথক সমাজের সাথে অনেকে আশ্রয় নিয়াছে। হয়ত তাহাদের পূর্ব পুরুষ যে চাকমা ছিল উহা জানিবারও উপায় হারাইয়া ফেলিয়াছে। অতীতে ব্রক্ষ্মদেশ , লুসাই হিল প্রভৃতি অঞ্চলের লোকেরা চাকমাদের ঐ একই চাক নামে পরিচিত করিয়াছে। সতীশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয় এক স্থানে উল্লেখ করিয়াছেন ‘ব্রক্ষ্ম দেশে অধিবাস কালে তদ্দেশীয়রা ছাকমা-চাকমা সংক্ষেপে কেবল ছাক নামে অভিহিত করিয়া থাকিবে’। অনেক স্থলে দেখা যায় যে জাতি অপর জাতির উপর প্রভুত্ব করে এবং রাজ্যের দন্ড মুন্ডের কর্তারা, রাজাও যদি এক জাতি এবং একই ধর্মীয়  হয় তবে অধীন জাতি স্বীয় স্বার্থ ও গৌরব বৃদ্ধি কল্পে শাসক শ্রেণীর সম মর্যাদা লাভের আকাঙ্খায় প্রভু জাতিয় দলের সামিল হওয়ার সুযোগ গ্রহণে অবহেলা করেনা। ইহাতে দেখা যায় ইহারাও অতীতের চাকমা জাতির এক বিলীয়মান শাখা বর্তমানে অন্য জাতিতে গণ্য হইয়া রহিয়াছে। এবং মুলত ঐ সম্প্রদায় চাকমা হইলেও বর্তমানে পৃথক রুপে পরিচিত।

    ইহার পরেই আমাদের আগ্রহ ও কৌতুহল উদয় হয় বিজয়গিরি যে চম্পকনগর হইতে আরাকান অভিযান করেন, ঐ স্থানের চাকমাদের কি হইল? চম্পকনগর আমরা দুই বা ততোধিক সংখ্যায় সাক্ষাৎ পাইলেও সতীশ চন্দ্র ঘোষ মহাশয় ত্রিপুরার নিকটস্থ ও শ্রীহট্টের দক্ষিন অংশে যে চম্পকনগরের অবস্থান নির্দেশ করেন , তিনি চাকমা জাতি ইতিহাসের এক স্থানে উল্লেখ করিয়াছেন উল্লেখিত স্থানে ও গারো পাহাড়ের নিকটস্থ অঞ্চলে এক চাকমা সম্প্রদায় দেখিতে পাওয়া যায় তাহারা উত্তরের চাকমা এবং বক্ষ্যমান জাতিকে দক্ষিণের চাকমা বলিয়া তিনি পরিচিত করেন। তথ্যে অবগত হওয়া যায় ঐ সম্প্রদায়ের চাকমারা নামের শেষে শাকমা লিখিয়া থাকেন। উত্তরে আর এক সম্প্রদায় আছেন যাহারা নামের শেষে লেখেন চাংমা। এই বিষয় আমাকে শ্রীযুক্ত প্রভাত কুমার চাকমা ( Retired Sub-Inspector of Police. ) মহাশয়ও জানাইয়াছেন। তিনি চাকুরি নিয়া কয়েক বৎসর ঐ জেলায় ছিলেন।

    কাল ক্রমে ঐ চম্পকনগর অথবা কালাবাঘা অঞ্চল ত্রিপুরা রাজার অধিভুক্ত হয়। কাজেই উত্তরের চাকমা যাহাদিগকে আমরা শাকমা ও চাংমা নামে পরিচয় করিতে চাহি, তাহারাও কালক্রমে বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমে ক্রমে ত্রিপুরার অধীনে থাকিয়া ত্রিপুরা জাতির দফায় প্রবিষ্ট হইয়া স্বাতন্ত্র হারাইয়া, ত্রিপুরা জাতিতে পরিণত হন। আবার অনেকে মনে করেন, হয়ত তাহারা গারো , কাছাড়ি প্রভৃতি জাতির সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে।

    ইহাতে অবগত হওয়া যায় ত্রিপুরার কোন কোন দফা-গোষ্টির সাথে চাকমাদের পরিচ্ছদ, পুজা-পার্বন ইত্যাদি যথেষ্ট মিল রহিয়াছে। ইহা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহাতে অনেকে মনে করেন, চাকমা ত্রিপুরার এক শাখা, অনুরুপ চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যেও, অনেকে মনে করেন চাকমা জাতির পিড়া ভাঙ্গা গোষ্ঠীর এক অংশ হয়ত ত্রিপুরা দফায় প্রবিষ্ট হইয়াছে। এই ধারণায় বশবর্তী হইয়া আবার অনেকে মনে করেন বিজয়গিরি, সমরগিরি ( চাকমা রাজন্যবৃন্দ ) প্রাচীন ত্রিপুরাধিপতি দেব মাণিক্য পুত্র। কিন্তু বাস্তবে তা নহে। ইহাদের নামগত সাধারণ সাদৃশ্য ছাড়া, তাহাদের কর্মময় জীবনের বিভিন্ন কার্যাবলীর সাথে কোনো কিছুর মিল দেখা যায় না।। তাহাদের কর্ম জীবনের সময় কালের ঘটনাও সম্পূর্ণ বিপরিত। কাজেই ইহাতে সংশয় রাখিবার কোন কারণ দেখা যায়না।

    ইহাতেই প্রতীয়মান হয় যে, তাহারা নানা ঘটনা প্রবাহের সাথে বিভিন্ন গোষ্টিতে, বিভিন্ন শাখায় ও বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়েন। অতীতে যাহারা উত্তরের চাকমা নামে পরিচিত ছিলেন, কালক্রমে তাহারাও এখন বিলুপ্তির পথে। ইহা ছাড়া পার্বত্য ত্রিপুরা জেলায়ও চাকমা সম্প্রদায়ের সংখ্যা নিতান্ত কম নহে। মাধব চন্দ্র চাকমা মহাশয়ের লিখিত শ্রীশ্রীরাজনামায় এক স্থানে উল্লেখ পাওয়া যায়, ১৩৪০ সনের সেন্সাস বিবরণীতে ত্রিপুরা রাজ্যে ঐ সময় চাকমাদের সংখ্যা ছিল ৮৭৩০ জন। তম্মধ্যে একমাত্র কৈলাস শহর ও অমর পুরে সমধিক। বর্তমানে ত্রিপুরায় ইহার সংখ্যা অনেক বেশী।    

    এক সময়ে ত্রিপুরা রাজা গোবিন্দ মানিক্য ভাইয়ের সাথে বিরোধের ফলে এই জেলায় আগমন করেন এবং মাইনি ভেলীর দিঘীনালা নামক স্থানে অবস্থান করার নিদর্শনাদির এখনও সন্ধান মিলে। আবার চাকমা রাজা শুকদেব রায়ের সঙ্গে ত্রিপুরা রাজার সখ্যতা স্থাপনের কারণে এক সময় ত্রিপুরা রাজা কতেক ত্রিপুরা প্রজা চাকমা রাজাকে উপহার প্রদান করেন, ইহার প্রমাণও পাওয়া যায়। কিন্তু চাকমাদের পক্ষ হইতে অতীতে ঐ ধরনের কোন চাকমা প্রজা, রাজপ্রদত্ত উপহাররুপে ত্রিপুরায় গমন করিয়াছেন বলিয়া কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। ইহাতে মনে হয়, ত্রিপুরার ঐসব চাকমারা আগে হইতেই সেখানে রহিয়া গিয়াছেন।

    চাকমারা প্রতিকুল অবস্থাতে স্থান পরিবর্তন করিতে বাধ্য হন। ইহাও তাহাদের স্থাবরসম্পত্তি বিহীনরুপ দারিদ্রের অন্যতম কারণ। তবে চাকমাদের রক্ষণশীলতার নিদর্শনরুপে দেখা যায়, তাহারা যখন চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে ছিলেন সেসময়ে ঐ সব স্থানে যেসব নাম ছিল পরিশেষে তাহারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আসিয়াও স্থানাদির নাম পুর্বের নামানুসারে রাখেন। যেমন আলীকদম, রাইংখ্যান, সাবেক্ষং ,ধামাই হিল, চারিখাং ইত্যাদি। অনুরুপ ১৯৫৯ ইংরেজিতে কাচলং রিজার্ভে পুনর্বাসিত হইয়া  প্লাবিত অঞ্চলগুলির নামানুসারে তাহারা ঐ স্থানগুলির নামকরণ করেন। মনে হয় এই রক্ষণশীলতার দৃষ্টিভঙ্গি তাহাদিগকে অতীতে খৃষ্টান মিশনারিদের কবল হইতে প্রায় ক্ষেত্রেই রক্ষা করিয়া আসিতেছে। এই জেলায় অষ্টাদশ শতাব্দী হইতে বহু বৎসর পর্যন্ত মিশনারিদের প্রবল প্রচেষ্টা সত্বেও অন্যান্য উপজাতিদের তুলনায় ইহাদের অতি স্বল্প সংখ্যক ধর্মান্তরিত করা সম্ভব হইয়াছে।

    ঐ রক্ষণশীলতার গুনে তাহারা বহু দেশ ও বিভিন্ন জাতির সংস্পর্শে আসিয়া , অবশেষে ব্রক্ষ্মদেশে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত অবস্থান করিলেও নিজের জাতিয় ভাষা , সংস্কৃতি ও বর্ণমালাগুলি বিসর্জন দেন নাই। আমি লক্ষ্য করিয়াছি শিক্ষিত লোকের চেয়ে গ্রাম্য নিরীহ , সরল ও সহজ মানুষেরা দুর্বার আগ্রহে তাহা রক্ষা করিতে সচেষ্ট।

    একমাত্র ব্রক্ষ্মদেশেই জাতি ও সমাজের উপর বিভিন্ন সংকটময় পরিস্থিতি উদ্ভবের কারণে , বহু স্থান পরিরর্তনের সাথে মুখ্যরুপে ঐ দেশে তিনটি রাজধানি পরিবর্তনের সংবাদ পাওয়া যায়। কাজেই ঐ দেশেই তাহারা হয়ত ব্রক্ষ্মীদের সঙ্গে আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া , পরস্পর বিভক্ত হইয়া, পৃথক সমাজের আশ্রয়ে নিজেরা সম্পূর্ণ ব্রক্ষ্মীরুপে , স্থায়ীভাবে সেই দেশে রহিয়া গিয়াছেন।

    চাকমাদের পূর্বপুরুষেরা যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিজ সন্তান নহে তাহা এই আলোচনা হইতে স্পষ্ট। এই ক্ষেত্রে আমরা অবগত হই যে, চাকমা, তঞ্চঙ্গা, দৈননাক  ও চাকরা বিভিন্ন সম্প্রদায়রুপে পরিচিত হইলেও মূলতঃ একই চাকমা জাতি এবং সিলেট ইত্যাদি অঞ্চলের যাহারা উত্তরের চাকমা রুপে পরিচিত ছিলেন , তাহারাও একই জাতির অর্ন্তভুক্ত।

    পৃথিবীর বিভিন্ন উপজাতির জীবন ও সংস্কৃতি সম্ভন্ধে গবেষেণা ও তার উৎপত্তির সন্ধান এক গভীর সমস্যার দাবী রাখে। ইহাতে নৃতত্বের গবেষণাদি তার প্রাচীন তথ্য ও পুরাতাত্বিক ঘটনাগুলির সমস্যা, একই জিজ্ঞাসা সবসময়ে লক্ষ্য করা যায়। কেননা কোন দেশ বা জাতির ইতিহাস পরিপূর্ণরুপ নহে। এই বিষয়ে আরো গভীর ও পূর্ণতর আলোচনা দরকার। অলিখিত ঐতিহাসিক যুগের বিশাল ক্ষেত্রের বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলি ও মূল্যবান তথ্যরাশি সুস্থ প্রকাশ ভঙ্গিতে, রচনা নৈপুণ্যে সন্নিবেশ করা কঠিন। কাজেই ইহার সমস্যা ও মলিনতা দূর করতঃ অপসৃয়মান একটা সুস্থ বিশ্লেষণী আভা প্রকাশ করা সকলের পক্ষে সম্ভব নহে।

    আমার দ্বারাও ইহা সম্ভব হইবেনা। জানিনা যাহাতে পরবর্তী কোন আগ্রহী ব্যক্তির পক্ষে , ইহা সম্ভবের বাহিরে না যায়, তজ্জন্য বিভিন্ন তথ্য ও বিবিধ গ্রন্থের বর্ণিত বর্ণনা ও মন্তব্য প্রভৃতি এই একটি বহির মধ্যে সমাবেশ করিয়া রাখা হইল। জাতির এই মূল্যবান সম্পদ যাহা ইতিহাসের আধাঁরী পথে বহুদিন অন্ধকার পর্যায়ে ঢাকা ছিল, অদূর ভবিষ্যতে আশা রহিল ইহা জাতির পরিচয় ক্ষেত্রে এক প্রামাণ্য গ্রন্থরুপে পরিচিত থাকিবে।

[ শ্রদ্ধেয় বিরাজ মোহন দেওয়ান লিখিত ‘ চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত ’ চতুর্থ পরিচ্ছেদ থেকে সংকলিত। চাকমা জাতির এমন মূল্যবান সম্পদকে নিজে জেনে এবং অপরকে জানানোর জন্য শেয়ার করা দরকার। Ojana-Kishu ব্লগ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ